বিডিনিউজ ১০, ইসলাম ডেস্ক: মানব বাগানে শিশুরা ফুল। শিশুরা স্বপ্ন। মায়েরা বাগানের মালী। মায়ের আদরে গড়ে ওঠে শিশু। মায়ের হাতে তাদের স্বপ্নের আগামী। বাবার স্নেহ ও শাসন সন্তান পরিচর্যায় সহায়ক। তবে মায়ের ভালোবাসা আদর স্নেহে নির্মিত হয় সন্তানের ভবিষ্যত। শিশুর স্বপ্নিল আগামী গড়তে লালন পালনে সচেতন হতে হয় অভিভাবকদের। এ আলোচনায় ইসলামের দৃষ্টিতে শিশু সন্তানের যত্নের বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো।
প্রথমেই দেহ গঠন:
দেহের পরিচর্যার ক্ষেত্রে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সংস্থান হতে হবে হালাল উপার্জনের মাধ্যমে। মায়েদের সন্তানের স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও বিনোদনের প্রতি যত্নবান হতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে মা-বাবাকে। ফকিহ্ সিরাজী (রহ.) শিশুর এই পরিচর্যার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘পশুর দুধে শিশুর পরিচর্যা তার স্বভাবকে ধ্বংস করে দেয়।’
ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বিষয়টির প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘ধর্মানুরাগী এবং হালাল ভক্ষণকারী নয়, এমন কোনো মহিলাকে যেন শিশুর লালন-পালন ও দুগ্ধপানের জন্যে নিয়োগ দেওয়া না হয়। কারণ হারামে দুধের মধ্যে কোনো বরকত থাকে না। সুতরাং এর থেকে শিশুর যে শারীরিক বিকাশ-সেটা হবে দুষ্টমূল থেকে তার গঠন। তখন তার স্বভাব দুষ্টুমি ও অপবিত্র বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়বে।’
শিশুর মন বনে সততার বীজ:
মন আলোকিত হোক প্রেমের জোছনায়, শিশুর মনে বীজ বুনুক সততার। ঈমানের আলোয় আলোকিত হোক শিশু মন। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার বক্তব্যে এই দিকেই ইঙ্গিত করেন- শিশুদের ‘কোরআন ও হাদিসের জ্ঞান আহরণ করাবেন। অধ্যয়ন করাবেন সাহাবাদের গল্প, আউলিয়ায়ে কেরামের জীবনী ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের ঘটনাবলী। যাতে আদর্শবান মানুষদের প্রতি ভালোবাসা অঙ্কুরিত হয়।’
এ ছাড়াও নান্দনিক চরিত্র ও ভালো আচরণে গড়ে তুলতে হবে শিশুদের। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেন, ‘শিশু হচ্ছে মা-বাবার নিকট আল্লাহ প্রদত্ত একটি আমানত। তার পবিত্র আত্মা যেকোনো ছবি ও অংকন থেকে মুক্ত, নির্মল ও উৎকৃষ্ট একটি রত্ন। সেখানে যা অংকিত হবে তাই সে গ্রহণ করতে সক্ষম। যেদিকে তাকে আকৃষ্ট করা হবে সেদিকেই সে আবুমান হবে। সুতরাং যদি কল্যাণকর বিষয় বা শিষ্টাচার শিক্ষা ও এর ওপর তাকে অভ্যস্ত করা হয়; তাহলে এভাবেই সে গড়ে উঠবে। সৌভাগ্য তার পদচুম্বন করবে ইহ ও পরলোকে। সে সফলতা ও পুরুস্কারে অংশীদার হবে তার মা-বাবা এমনকি শিক্ষকরাও। পক্ষান্তরে যদি তাকে আল্লাহ না করুন, চতুষ্পদ জন্তুর মতো ছেড়ে দিয়ে অকল্যাণ ও মন্দের ওপর অভ্যস্ত করা হয়, তাহলে সে হবে ব্যর্থমনোরথ ও হতভাগ্য। তখন এর দায়ভার সন্তানের লালন-পালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবকদের কাধে গিয়ে পড়বে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
ياأَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
‘হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের এবং পরিবার পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা কর….।’
বুদ্ধির খেলায় এগিয়ে দিন:
শিশুদের স্বপ্ন আঁকতে সহায়তা করুন। জ্ঞান-ভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করুন। বইপাঠ, প্রকৃতি পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলুন। গল্পে গল্পে ওদের মেধা-মননে বিস্তার করুন বুদ্ধির বীজ।
প্রতিপালনের স্তরসমূহ:
পার্থিব জীবনে মানুষের বয়োঃস্তর অনেকভাবে বিভক্ত। কৈশোর, যৌবন, বৃদ্ধ। ধাপে ধাপে এগুলোরও কয়েকটি স্তর রয়েছে। প্রথমতো মানুষের বয়োঃস্তর দু’টো বিস্তৃত অধ্যায়ে বিভক্ত।
যে ভাবনায় সন্তান প্রতিপালন:
বহুমাত্রিক বংশ গোত্রের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হয়। কোরআন বলছে,
وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا
‘এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হও!’
সমাজের ভিন্ন চেহারা। যা মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে তথা সন্তান-সন্ততি নিয়ে গঠিত। পরিবারের সম্পর্ক সুদৃঢ়। একটি পরিবারের উত্তম পরিচর্যার মাধ্যমে সমাজের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। সমাজের সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম ব্যক্তিকে সমাজের একটি যোগ্য অঙ্গ হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে। এখান থেকে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, সভ্যতা-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়ে সে হবে সমাজের জন্য আদর্শ।
বাস্তব কর্ম, চিন্তা ও গবেষণায় ভারসাম্য আনয়নের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে থাকবে সদা নিবেদিতপ্রাণ। এটাই হলো সার্বজনীন তরবিয়তের এর মূল লক্ষ্য।
ইসলামি সমাজের জন্য সার্বজনীন তরবিয়তের লক্ষ্য হলো, ব্যক্তিকে প্রস্তুত করতে হবে ইসলামি সুউচ্চ ইমারতের একটি ইট হিসেবে যিনি ইসলামের হাকিকত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও তার বাস্তব অনুশীলন, সমাজ উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং বিশ্ববাসীর কাছে আল্লাহর দ্বীন পৌঁছানোর ব্রতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করবেন। যাতে আল্লাহ প্রদত্ত সকল যোগ্যতা ও সর্বশক্তি ব্যয় করে তাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সে বাস্তবায়িত করতে পারে।
যাদের হাত ধরে সন্তানের পথ চলা!
তরবিয়ত বা লালন-পালন একটি চারিত্রিক কর্মতৎপরতা, শিষ্টাচারগত বাধ্যকতা ও দায়িত্ব। বয়স ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ দায়িত্ব অনেকের ওপরই বর্তায়। কখনও বাবা মা নিজেই সন্তান লালন পালন করেন। কখনও নিকটাত্মীয় বা কখনও নিয়োজিত ব্যক্তি। তবে এ দায়িত্ব সর্বপ্রথম বাবা-মার ওপরই বর্তায়। তারপর তাদের নিযুক্ত কোনো প্রতিনিধি। প্রয়োজন হলে সকলে মিলে পালন করতে পারেন শিশু পরিচর্যার এ মহান দায়িত্ব।
বয়োঃপ্রাপ্তি পর্যন্ত সন্তানের লালন-পালন, যত্ন ও পরিচর্যা, শিষ্টাচার শিক্ষাদানের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবে মা-বাবা ও অভিভাবকদের ওপর বর্তায়। এ মর্মে শরিয়তের সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
‘তোমরা নিজেদের এবং আপন পরিবার-পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর!।’
সাহাবি কাতাদাহ (রা.) বলেন, ‘অভিভাবক তাদের রক্ষা করবে, তাদের আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ করবে, তার নাফরমানী থেকে নিবৃত করবে এবং আল্লাহর নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব নেবে, আল্লাহর আদেশ পালনের নির্দেশ প্রদান ও তাতে সহযোগিতা করবে। যখনই আল্লাহর কোনো নাফরমানী গোচরে আসবে তাদের তা হতে ফিরিয়ে রাখবে।’
ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘তাদের সৎ কাজের আদেশ কর, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখ আর অযথা কাজে ছেড়ে দিও না। তাহলে কিয়ামত দিবসে অগ্নি তাদের গ্রাস করে ফেলবে।’
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته
‘তোমরা প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে।’
এ হাদীসের দাবি মতে, ‘একজন ব্যক্তি হবে তার পরিবারে দায়িত্বশীল কর্তা ও তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এমনিভাবে একজন মহিলা তার স্বামীর গৃহে দায়িত্বশীলা গৃহিণী এবং তাকেও নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। অতএব, প্রত্যেকেই এক-একজন দায়িত্বশীল এবং তোমাদের সকলকেই নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
علموالصبي الصلاة ابن سبع سنين واضربواعليها ابن عشر
‘সন্তানের বয়স সাত বছর হলে নামাজ শিক্ষা দাও! ও বয়স দশ বছর হলে নামাজের জন্য তাকে প্রহার কর।’
সারকথা, প্রশিক্ষিত একজন মানুষকে যিনি ধর্মীয় জ্ঞান ও তদানুযায়ী আমলে সমৃদ্ধ তাকে নিয়োজিত রাখতে হবে শিশুর জন্য । সঙ্গে সঙ্গে জাগতিক জীবনে নিজ কর্তব্য পালনে তাকে যোগ্য ও সচেতন করে তোলা হবে তার দায়িত্ব। যাতে সে কারো মুখাপেক্ষী বা অন্যের ওপর বোঝা হয়ে না থাকতে পারে। আর একটি শিশুকে (সন্তান) এভাবে গড়ে তোলার এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটা হলো অভিভাবকের।
শৈশবকালে বাবা-মার দায়িত্ব ও আধুনিক বিজ্ঞান:
শৈশবকাল সাধারণত একটি শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তিপূর্ব বয়োঃস্তর। এটা শিশুর জন্মের পর থেকে পাঁচ/ছয় বছর বয়স পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে। তবে অবশ্যই তা সাত বছরের বেশি হতে পারবে না। এ বয়স স্তরটা মানবজীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। যেহেতু পরবর্তী বয়োঃস্তরের জন্য এটা হচ্ছে ভিত্তি স্তম্ভ, এর ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়াতে শিখবে জীবনের অনুজ স্তরসমূহ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বাণীতে এর সুস্পষ্ট বর্ণনা করেছেন,
كل مولود يولد علىالفطرة حتى يعرب عنه لسانه فأباه يهودانه أوينصران.
‘প্রতিটি নবজাতক স্বভাবজাত ধর্ম ইসলামের ওপর ভূমিষ্ঠ হয় ও তার কথা ফোটা পর্যন্ত এ অবস্থার ওপর সে প্রতিষ্ঠিত থাকে। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহুদী অথবা খৃস্টান বানায়।’
যখন শিশু কথা বলতে ও মনের ভাব ব্যক্ত করতে শেখে, তখন তার মা-বাবা তাকে নিজ ধর্মে আবদ্ধ করে ফেলে। এখান থেকেই বয়সের এই স্তরের গুরুত্ব, কিভাবে তাকে প্রতিপালন, বিকাশ ও প্রস্তুতকরণের মধ্য দিয়ে একটি ছোট্ট শিশুর ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব তা স্পষ্ট হয়ে যায়। এমনিভাবে একটি শিশুর পিতা তাকে যে বিষয়ে অভ্যস্ত করবে তার ওপরই সে গড়ে উঠবে।
শৈশব অধ্যায়টা যেহেতু একজন মানুষের বয়স পনের কিংবা তার চেয়ে বেশি সময় পর্যন্ত প্রলম্বিত, সে কারণে এই শৈশব স্তরের গুরুত্বও অপরিসীম। শিশুর বিকাশ ও বেড়ে ওঠা অনুযায়ী এখানে তাকে বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার প্রয়োজন। যাতে সে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনা গ্রহণে সক্ষম হয়।
মানব বয়সের প্রাথমিক বছরগুলোতে তরবিয়ত তথা প্রতিপালন ও পরিচর্যার তাৎপর্যের ওপর আধুনিক বিজ্ঞান দিয়েছে সবিশেষ গুরুত্ব। সেহেতু ব্যক্তিত্বের বিকাশ চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোপরি তার জীবনের লক্ষ্য বিনির্মাণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কারণ এ সময় সে পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণ করতে পারে যা তার জীবনের প্রতিটি বাঁকে সঠিক বিকাশে সহায়তা করবে।